ভেষজ চিকিৎসার প্রসারে সম্মত ভারত-বাংলাদেশ - বিবিসি প্রতিবেদন


  • ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪


আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার ব্যাপারে সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ঢাকায় আঞ্চলিক এক স্বাস্থ্য সম্মেলনে দু'দেশের সরকারের মধ্যে সম্প্রতি এই সমঝোতা হয়েছে।
হিন্দুধর্মগ্রন্থ বেদ-এ উল্লেখিত চিকিৎসা ব্যবস্থা আয়ুর্বেদ, অবিভক্ত ভারতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি বলে মনে করা হত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা যত উন্নত হয়েছে, তত কমেছে আয়ুর্বেদের প্রভাব। তবে সম্প্রতি ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ওপরে সরকারের নজর পড়েছে। সাধারণ মানুষও অ্যালোপ্যাথিতে ব্যর্থ হয়ে আয়ুর্বেদের শরণ নিতে শুরু করেছেন, তৈরি হয়েছে আয়ুর্বেদিক ওষুধ আর চিকিৎসার জন্য নতুন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও।
কলকাতায় সরকার পরিচালিত জেবি রায় আর্য়ুবেদিক মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ২০০-৩০০ মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। প্রায় ১০০ বছরের পুরনো এই সরকারি মেডিক্যাল কলেজটির অধ্যক্ষ ডা. জি সি পোল্লে বলছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার থেকে আয়ুর্বেদ বেশী কাজ দেয়, তাই তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
আয়ূর্বেদ চিকিৎসা কেন্দ্রে ক'জন রোগী
Image captionআয়ূর্বেদ চিকিৎসা কেন্দ্রে ক'জন রোগী।
''অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক বা ওই ধরনের ওষুধের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। অন্যদিকে আয়ুর্বেদের মূল কথাই হল রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এই জায়গাতেই আমরা শ্রেষ্ঠ,'' বলেন ডা. জি সি পোল্লে।
নতুন করে যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আয়ুর্বেদ বা ইউনানীর মতো প্রাচীন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করছেন, সেরকমই একটি – ‘নেচারোভেদা’র প্রধান খালেদ মুহম্মদ সইফুল্লার কথায়, ''অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আজকাল মানুষ খুবই বিব্রত। একটা অসুখ সারানোর ওষুধ খেলে নতুন কোনও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে আয়ুর্বেদ, ইউনানী বা যোগের মতো প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কোনও সমস্যা হয় না। সেটাই বুঝছেন অনেক মানুষ, তাই প্রাচীন পদ্ধতিগুলোতে চিকিৎসা করাতে আসছেন তাঁরা।''
তবে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা যাঁরা করাতে আসেন, তাঁদের বেশীরভাগই অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় ভাল ফল না পাওয়ার পরে প্রাচীন পদ্ধতিগুলির শরণ নিচ্ছেন, মন্তব্য ওই সংস্থারই চিকিৎসক – ডা. আফতাব আলম হুসেইনের।
সরকারি মেডিক্যাল কলেজ আর বেসরকারি ক্লিনিকের কয়েকজন রোগীও বলছিলেন যে তাঁরা অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা করিয়ে ভাল ফল পান নি অথবা রোগ পুরোপুরি সারছে না – ফিরে আসছে। সেজন্যই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করাতে এসেছেন তাঁরা।
শতাব্দী প্রাচীন আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠান ঢাকা সাধনা ঔষধালয়ের এক কর্মী সুনীল ভট্টাচার্য বলছিলেন, ''আর্য়ুবেদিক ওষুধ আসলে চটজলদি ফল দেয় না। ঠিকমতো অনুপান দিয়ে দীর্ঘসময়ে ধরে খেতে হয়। অ্যালোপ্যাথিক বড়ির মতো জল দিয়ে খেয়ে নিলেই কাজ হয় না। আজকাল মানুষের আসলে সেই ধৈর্যটাই নেই।''
আয়ুর্বেদের প্রতি মানুষের নতুন করে ফিরে পাওয়া ভরসার ফলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারও জোড় দিচ্ছে আয়ূর্বেদ নিয়ে নতুন গবেষণা আর ওষুধ তৈরিসহ নানা পরিকাঠামো উন্নয়নে। আসছে ভারত সরকারের আর্থিক সাহায্যও।
আয়ূর্বেদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে দুই বাংলাতেই।
Image captionআয়ূর্বেদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে দুই বাংলাতেই।
রাজ্যের আয়ূষ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিষদীয় সচিব ডা. নির্মল মাঝি জানালেন, ''নিজে একজন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক আমি। এছাড়াও রাজ্য অ্যালোপ্যাথিক মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি।''
''তা স্বত্ত্বেও আমার উপলব্ধি হচ্ছে যে একবিংশ শতাব্দীতে এসে সবসময়ে আমরা যে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিই বা নিজেরা খাই, তার সঙ্গেই কিন্তু প্রাচীন আয়ুর্বেদও আমাদের রাজ্যে অন্তত একশ্রেণীর মানুষের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয়।''
রাজ্য সরকারের দাবি, আয়ুর্বেদের উন্নতির জন্য একদিকে যেমন প্রাচীন পুঁথি থেকে তথ্য যোগাড় করা হচ্ছে, তেমনই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন ওষুধের জন্য গবেষণা হচ্ছে, আবার উন্নত যন্ত্রপাতিও আনা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি ভেষজ উদ্যান আর চাষীদের দিয়ে বেশী করে আয়ূর্বেদের জন্য দরকারি গাছগাছড়ার চাষও করানো হচ্ছে।''
একটা সময়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গেই পূর্ব আর পশ্চিম – দুই বাংলাতেই কবিরাজদের রমরমা ছিল প্রবল। বিভিন্ন কবিরাজী ওষুধ গুঁড়ো করার জন্য অনেক বাড়ীতেই থাকত খল-নুড়ি।
সকালে দশন-সংস্কার চূর্ণ দিয়ে দাঁত মাজা হোক আর পেট পরিষ্কার রাখার জন্য ত্রিফলার জল খাওয়া, বা অত্যধিক ভোজনের পরে লবন ভাস্কর চূর্ণ বা স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য ব্রাহ্মী রসায়ন - এগুলোর মাধ্যমে বহু মানুষের জীবনে আর্য়ুবেদ ওতপ্রোতভাবেই জড়িত ছিল।
সেই প্রায় ৫০০০ বছরের পুরনো আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতি একসময়ে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেললেও এখন আবার ফিরে আসছে – এমনটাই মনে করেন চিকিৎসক আর রোগীদের একাংশ।

Comments

Popular posts from this blog

ভেষজ চিকিৎসাই আগামীর চিকিৎসা